কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে দুই ডজন কারণ

কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে দুই ডজন কারণ

এ মুহূর্তে সমাজের তিন ব্যাধি (কিশোর গ্যাং, মাদক, টিকটক) নিয়ে সবাই বেশ উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে কিশোর গ্যাংয়ের খুন, ধর্ষণসহ নানা অপকর্ম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এ গ্যাং গড়ে তোলার নেপথ্যে রয়েছে অন্তত দুই ডজন মূল কারণ- এমনটি মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, অস্ত্র ও মাদকের দৌরাত্ম্য, ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশ, বিশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশ, কর্মহীনতা এবং হতাশা বোধ থেকে কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে ‘গ্যাং কালচারে’। এছাড়া একাকিত্ব, অভিভাবকের সান্নিধ্য না পাওয়া, শিক্ষকদের অতিমাত্রার শাসন, খারাপ ফলাফল, সহপাঠীর মাধ্যমে বিদ্রুপ এবং স্কুলের ম্যানেজমেন্টের অব্যবস্থাপনার ও পাঠদান প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার বিষয়গুলো উসকে দিচ্ছে গ্যাং কালচার। কো-এডুকেশনে হিরোইজম, খারাপ সাহচর্য, আড্ডাবাজি, অপরাধ জগতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা থেকে অনেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হচ্ছে। পাশাপাশি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার হাতছানি, অল্প বয়সে যৌন আসক্তি, হীনমন্যতা থেকে ব্যক্তি সত্তা প্রমাণের চেষ্টা, দস্যুপনা, দুরন্তপনা ও চরমপন্থা মনোভাব থেকেও গ্যাংয়ে যোগ দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সারা দেশেই কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষক রয়েছে। রাজধানীতেই আছে শতাধিক নিয়ন্ত্রক। পর্দার আড়ালে থেকে রাজনৈতিক অভিমত, একই সমাজ ব্যবস্থার ভেতর যখন দরিদ্র শ্রেণি ও উচ্চবিত্তের বসবাস থাকে তখন উচ্চবিত্তের জীবনযাত্রা দেখে দরিদ্র শ্রেণির সন্তানরা নিজেদের ভাগ্যবঞ্চিত মনে করে। তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়। এ হতাশা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সৃষ্টি হতে পারে। সমাজে অস্ত্র ও মাদকের দৌরাত্ম্য গ্যাং কালচারকে উসকে দেয়। সমাজে যখন একটি গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকে তখন তার বিপরীতে আরেকটি গ্যাং তৈরি হতে পারে। একে অপরকে দেখে অনেকে গ্যাং সদস্য হতে উৎসাহী হয়। সিনিয়ররা যখন জুনিয়রদের নিরাপত্তা দিতে না পারে তখন জুনিয়ররা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ে। ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশে কিশোররা সহিংসতা সম্পর্কে জানতে পারে। সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়ে ওই কালচার রপ্ত করতে চায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান যুগান্তরকে বলেন, পারিবারিক বিশৃঙ্খল অথবা বিচ্ছিন্ন পরিবারের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। অনেক নেশাগ্রস্ত পরিবার আছে। সেখানে মাদক বা নেশাজাতীয় দ্রব্যের আসর বসে। কোনো পরিবারের কেউ গ্যাং সদস্য থাকলে পরিবারের অন্য সদস্য এতে যুক্ত হতে পারে। পরিবারের কোনো সদস্য বা পিতা-মাতা রোল মডেল হতে ব্যর্থ হলে বা পিতামাতার কর্ম অদক্ষতা ও বেকারত্বের ফলে আর্থিক উপার্জনের জন্য সন্তানদের মধ্যে গ্যাং সদস্য হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। আবার কখনও কখনও কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী পিতামাতার পক্ষে সন্তানকে সময় দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। এতে সন্তানের মধ্যে একাকিত্ব ও হতাশা তৈরি হয়। কোনো পরিবারে একাধিক বিয়ে থাকলে সৎভাই-বোনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হয়। যেখানে পারিবারিক অশান্তি থাকে সেখানে পিতামাতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকে। তখন সন্তানের প্রতি মা-বাবার কন্ট্রোল থাকে না। এ সুযোগে সন্তানরা বখে যায়। একপর্যায়ে যোগ দেয় গ্যাংয়ের সঙ্গে।

সম্প্রতি পুলিশের বিশেষ শাখার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদের লেখাপড়ার চাপ নেই। অনেক কর্মজীবী কিশোর কাজ হারিয়েছে। তারা ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একত্রিত হয়ে বাহারি ও চটকদার নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। রাজধানীর ডেমরা, সূত্রাপুর, সবুজবাগ, খিলক্ষেত, কোতোয়ালি, উত্তরা, তুরাগ, খিলগাঁও, দক্ষিণখান এবং টঙ্গী এলাকায় ৩২টি কিশোর গ্যাং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এসব গ্যাংয়ে কিশোরের সংখ্যা ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেক গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রক রয়েছে। এদের বেশিরভাগই হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল। কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তাদের ধরতে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে। তাই কৌশলগত কারণে এ মুহূর্তে তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যেসব সন্তানের ওপর অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ নেই তারা সহজেই গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে। অল্প বয়সিদের মধ্যে সহজেই হিরো হওয়ার প্রবণতা এবং মাদক সেবনে জড়িত হওয়া গ্যাং কালচারের গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তিনি বলেন, ডিএমপিতে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা আগে থেকেই আছে। নতুন করে কোনো গ্যাং তৈরি হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে প্রত্যেক অপরাধ বিভাগের ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। এছাড়া অপরাধ বিভাগের উপ-কমিশনারের কার্যালয় এবং থানা পুলিশের মাধ্যমে মোটিভেশনাল কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কোনো বড় ধরনের অপরাধ হলে মামলা হয়। তখন কিশোর অপরাধীদের ধরে আইনের আওতায় আনি। কিন্তু কিশোররা অহরহ ছোটখাটো অপরাধ করছে। বিষয়টি কেউ আমলে নিচ্ছে না। পুলিশকেও জানাচ্ছে না। তাই ছোটখাটো অপরাধে অভ্যস্ত হওয়ার পর তারা বড় ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে বলে ডিএমপি কমিশনার জানান।

ডিএমপির অন্য একটি সূত্র জানায়, রাজধানীতে থাকা কিশোর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে রয়েছে নাফিজ আলম ডন (পাওয়ার বয়েজ), সেতু বিন সাত্তার (ডিসকো বয়েস), আক্তারুজ্জামান ছোটন (বিগ বস), রাজু ওরফে তালাচবি রাজু (নাইন স্টার), নাঈম কমিশনার (নাইন এমএম বয়েজ), সাদাত বিন জাকির (এনএনএস), জাহিদুল ইসলাম জুইস (জিইউ), জিহান (এফএইচবি), পোটলা বাবু ওরফে আব্দুল্লাহ (ক্যাকরা), জুয়েল (কে-নাইন), হাফিজুল ইসলাম বাবু (মিরপুর, কাফরুল, ভাষানটেক) বিহারি রাসেল, বাবু ওরফে পিচ্চি বাবু, সাইফুল, সাব্বির গ্যাং, রাজন, তেজগাঁয়ের মাঈনুদ্দিন, কাফরুলের নয়ন, উত্তরার শান্ত, আটিপাড়ার শান্ত ও মেহেদী, বংশালের জুম্মন, মুগদার চান-জাদু প্রমুখ। এছাড়া মিরপুর -১ নম্বরের শাহ আলী মাজার এলাকায় সোহেলের নেতৃত্বে একটি গ্যাং ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকে। এ গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে আকাশ, তুফান, ইসলাম, রাফি, আলী, হাসান মামুন, রাব্বি প্রমুখ। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ গ্যাং সদসদের শেলটারদাতা বা নিয়ন্ত্রক হলো নাবিল খান।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে জানান, দুর্বল ছাত্রদের মধ্যে গ্যাং গড়ে তোলার প্রবণতা থাকে। শিক্ষকদের অতিমাত্রার শাসন, খারাপ ফলাফল, সহপাঠীর মাধ্যমে বিদ্রুপের শিকার থেকে হতাশার তৈরি হতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিনিয়র-জুনিয়রদের অতিরিক্ত বৈষম্যও কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম দিতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজমান একটি গ্যাং আরেকটি গ্যাংয়ের জন্ম দিতে পারে। স্কুলের ম্যানেজমেন্টের অব্যবস্থাপনার কারণে পাঠদান প্রক্রিয়া ব্যাহত থাকলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা জাগ্রত হতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদককে কেন্দ্র করে আড্ডা দেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। তিনি বলেন, কো-এডুকেশনে হিরোইজম দেখানোকে কেন্দ্র করে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গ্যাংয়ের সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এক বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তাই তাদের হাতে সময়ের অভাব নেই। এ সুযোগে তারা গ্যাং কালচারে জড়িত হচ্ছে। র‌্যাব পরিচালক বলেন, সাহচর্যের অপরাধপ্রবণতা, ভালো বন্ধুর চেয়ে যদি খারাপ বন্ধুর সংখ্যা বেশি, খারাপ বন্ধুর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, সাহচর্যের আড্ডাবাজ প্রবণতা, মাদক সেবনের প্রবণতা, মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং অপরাধীর সঙ্গে নতুন বন্ধুত্ব গ্যাং কালচার সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, কিশোর অপরাধী এবং তাদের নিয়ন্ত্রকদের আইনের আওতায় আনতে র‌্যাবের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন